সম্পাদকীয়

গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ ও গণমাধ্যম

গণমাধ্যম সব সময় গণতন্ত্রের পরিপূরক। গণতন্ত্র মানে যদি হয় জনগণের মাধ্যমে জনগণের জন্যই নিবেদিত শাসন ব্যবস্থা বা তার রূপরেখা, তাহলে গণমাধ্যমের লক্ষ্য বা কাজের সঙ্গে তা পুরোপরি মিলে যায়। গণতন্ত্র এবং গণমাধ্যমের উদ্ভব জনস্বার্থেই, তাই তাদের উদ্দেশ্যগত দৃষ্টিভঙ্গি একই। তারপরও শাসকগোষ্ঠীর আক্রমণের বিধ্বংসী তীর বার বার নিক্ষিপ্ত হয়েছে গণমাধ্যমের দিকেই। গণমাধ্যমকর্মীরা নির্যাতিত হলে সবাই খুশি হয়। পুলিশ নামকাওয়াস্তে সাধারণ ডায়েরি নিয়ে নির্বিঘ্নে ঘুমায়। সে সময় যারা গদিনসীন তারা স্ব্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সাংবাদিকদের আক্রান্ত হতে দেখে। প্রায়ই সাংবাদিক ঠ্যাঙানোর জন্য লেলিয়ে দেয়া হয় দলীয় ক্যাডারদের। গণমাধ্যমকে যদি ছায়া সংসদ ধরা হয় তাহলে গণমাধ্যমের দায়িত্ব কী দাঁড়ায়? এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যম যদি সরকারের নানা ভুল-ত্রুটি উন্মোচন করে জনঅসন্তোষের কারণ সরকারের সামনে তুলে ধরে তাহলেই চটে যায় সরকার। সবচেয়ে হাস্যকর হচ্ছে, তাদের কেউ কেউ অজ্ঞতাবশত গণমাধ্যমের ভূমিকাকে দেশের স্থিতিশীলতা বিনষ্ট ও গণতন্ত্রের জন্য হুমকিস্বরূপ বিবেচনার প্রয়াস পেয়েছেন। আজব দেশে সবই সম্ভব। যে দেশে একজন উপজেলা চেয়ারম্যানকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যার দায়ে অভিযুক্তরা জনসম্মুখে ঘুরে বেড়ালেও পুলিশ তাদের কাউকে গ্রেফতার করতে পারে না, আবার ট্রেন পোড়ানোর অজ্ঞাতনামা মামলায় রাতারাতি ৭৫ জনকে গ্রেফতার করে ফেলে। এ দেশেই সম্ভব একটি ভয়াবহ রক্তাক্ত বোমা হামলার ঘটনায় জজ মিয়া নাটক রচনা। অথচ গণমাধ্যম হচ্ছে গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত। বর্তমান সংসদে বিরোধী দল নেই। তাই বাধ্য হয়ে গণমাধ্যমকে বিরোধী দলের কাজগুলো করে দিতে হয় । এতেই বর্তমান সরকার গণমাধ্যমকে তাদের প্রতিপক্ষ ভেবে বসে আছে। আসলে কি তাই? গণমাধ্যমের কাজই তো গণধারণাগুলোকে জোরালোভাবে তুলে ধরা। এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যম যদি ছাত্রলীগ, যুবলীগের ‘মহান’ কর্মগুলো ঢেকে রেখে তাদের মিথ্যা প্রশংসায় ব্যস্ত হয় তাহলে জনমানুষের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে কী জবাব দেবে সাংবাদিকরা। বিবেকের দংশন থেকে বাঁচতে হলে নিশ্চয়ই কালোকে কালো বলতে হবে তাদের। গণমাধ্যমের পাঠক বা দর্শক যেহেতু জনগণ তাই গণমাধ্যম জবাবদিহি করবে শুধু জনগণের কাছে। গণমাধ্যমের জবাবদিহিতা কোনোভাবেই সরকারের কাছে নয়। সরকারি আমলারা আর কিছু না পারলেও গুরুত্বপূর্ণ ফাইল আটকে রাখতে বিশেষ পারদর্শী। তাদের ঘুষের কাহিনী গণমাধ্যমে এলে তারা গণমাধ্যমের উপর চটেন। রাজনীতিকদের স্বেচ্ছাচারী কর্মকাণ্ড গণমাধ্যম প্রকাশ করলে তারা গণমাধ্যমকর্মীদের ঠ্যাঙান। খুনের দায়ে অভিযুক্ত এক আসামির পক্ষে একজন পুলিশ কমিশনারের কসম কেটে সাফাই গাওয়া নিয়ে গণমাধ্যম সমালোচনা করলে পুলিশ গণমাধ্যমের উপর চড়াও হয়। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মিছিল-মিটিংসহ বিভিন্ন সংঘর্ষকালীন সংবাদ সংগ্রহ করতে গেলে সাংবাদিক পেটান, মাঝে মধ্যে বাসায় গিয়েও পেটান। এখন শোনা যায়, সাংবাদিককে বাইক থেকে নামিয়ে পুলিশ বক্সের ভেতর নিয়ে পেটানোর কথা। পরে পুলিশ সার্জেন্ট ঔদ্ধত্যের সঙ্গে সাংবাদিক পেটানোর কথা স্বীকার করেন। সাংবাদিক পেটালে কারও কখনও চাকরি যায়নি, ভবিষ্যতেও যাবে না। এই পুলিশকে যখন আবার ক্ষমতাধর কেউ ঠ্যাঙান, তখন সাংবাদিকরা এ খবর কাভার করতে গিয়ে আরেক দফা পিটুনি খান। পরে দু’পক্ষের মধ্যে সমঝোতা হয়ে গেলে অতিরঞ্জিত সংবাদ প্রকাশের দায়ভার মাথায় নেন সাংবাদিকরাই। তারপরও নেশার টানে পেশাজীবী সাংবাদিক ছুটে চলেন তার কর্মস্থলে। জনমানুষের জন্য সংবাদ পরিবেশনাতেই তাদের আনন্দ। দেশের রাজনীতিকরা দেশের বিশেষ সঙ্কটকালে যখন গভীর জলে ডুব দেন তখন গণমাধ্যমই সর্বপ্রথম স্বৈরশাসন তথা অন্যায় অপরাধের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। ১/১১-এর যে দায়ভার আজ গণমাধ্যমের উপর চাপানোর চেষ্টা চলছে, এভাবে চলতে থাকলে আরেকটা ১/১১-এর মুখোমুখি হয়তো হবে দেশ। সে সময় রাজনীতিকরা কেউ নব্য রাজাদের সঙ্গে হাত মেলাবেন, কেউবা দেশে-বিদেশে আত্মগোপন করবেন, মাঝখান দিয়ে ঝড়ঝঞ্ঝা যা সওয়ার তা সইবেন সাংবাদিকরা। তাদের কাছে প্রেস অ্যাডভাইস পাঠানো হয়, এ অ্যাডভাইস উপেক্ষা করলে সাংবাদিকের চাকরি চলে যায়। রিমান্ডে নিয়ে স্বীকারোক্তি আদায়ের হুমকি দেয়া হয়। কোনো কোনো সাংবাদিককে দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়। তারপরও সাংবাদিকরা দেশ ও জনগণের স্বার্থে লেখে চলেন। আমাদের দেশে ৯০-পরবর্তী গণতান্ত্রিক আমলে গণমাধ্যম ও তার কর্মীদের উপর নির্যাতন-নিপীড়ন বন্ধ হয়নি, বরং নির্যাতনের মাত্রা কোনো কোনো সময় সামরিক শাসকদের ছাড়িয়ে গেছে। ১৯৭১ সালে পাক হানাদাররা পূর্ব-পাকিস্তানে অধিকাংশ সংবাদপত্র অফিস পুড়িয়ে দিয়েছিল। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় থেকে এ পর্যন্ত এ দেশে সাংবাদিক হত্যা অব্যাহত রয়েছে। সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ব্যাপার হচ্ছে, গত দু’দশকে প্রায় ৩০ জনের মতো সাংবাদিক নিহত হলেও আজ পর্যন্ত একজন সাংবাদিক হত্যারও বিচার হয়নি। সরকার আইনের যাঁতাকলে সব সময় গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। কোনো দলই ক্ষমতায় থাকতে এ সত্যটি বুঝে না যে, গণমাধ্যম তার নিজস্ব নীতিতে দেশ ও সরকারের কল্যাণে সরকারকে সাবধান করতে বৈরী সংবাদ পরিবেশন করে। অথচ বর্তমান পৃথিবীর প্রায় সব গণতান্ত্রিক দেশেই সরকারের জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতার জন্য গণমাধ্যমের ভূমিকা ব্যাপকভাবে স্বীকৃত। সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিতের জন্য জনগণের কাছে সরকারি প্রতিষ্ঠানসহ তার কর্মকর্তাদের পর্যাপ্ত তথ্য থাকা প্রয়োজন। আর এ কাজটাই করে থাকে গণমাধ্যম। সংসদ, আদালত ও নির্বাহী বিভাগ রাষ্ট্রের দেশের এ তিনটি প্রধান শাখা যদি গণমাধ্যমকে নিজেদের প্রতিপক্ষ ভাবে তাহলে তা গণমাধ্যম শিল্পের জন্য অবশ্যই একটি অশনিসঙ্কেত। বর্তমানে আমাদের দেশে মিডিয়ার সংখ্যা বাড়লেও এডের বাজার বাড়েনি। তার উপর নিউজপ্রিন্টের দাম দিন দিন বেড়েই চলছে। সরকারি বিজ্ঞাপনের জন্য সংবাদপত্রকে টাকা দেয়া হলেও চ্যানেলগুলোর জন্য তা মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। তাদের একে তো টাকা দেয়া হয় না, উল্টো বলা হয় গুরুত্বপূর্ণ সময়ে বিজ্ঞাপনগুলো প্রচার করার জন্য। বাংলাদেশে তথ্য অধিকার আইন পাস হয়েছে, তবে তার বাস্তবায়ন দেখার জন্য আমাদের কতদিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে—মাস কি বছর, কে জানে? বর্তমান বিশ্বে এখনও আলোচনা, দাবি ও সংগ্রাম চলছে সুস্থ গণতন্ত্রের জন্য, স্বাধীন গণমাধ্যমের জন্য। গণমাধ্যম গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার এ আন্দোলন-সংগ্রামে গণমানুষের গণযোগাযোগ স্থাপনে সেতুবন্ধ হিসেবে কাজ করছে। এতে বরাবরই শাসকগোষ্ঠী থেকে তীব্র বাধা এসেছে, ভবিষ্যতেও আসবে। উইকিলিকস প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ বাঁচার আশা ত্যাগ করে সংগ্রামে নেমেছেন। তাকে একবার কারারুদ্ধ করা হয়েছে, এরপর হয়তো জীবনরুদ্ধ করা হবে। তবু গণমাধ্যমের অগ্রযাত্রাকে রুদ্ধ করা যাবে না। গণমাধ্যম সব সময় লিও সিয়াবোর মতো মানবাধিকার-কর্মীদের পক্ষ নেবেই। মানুষ, মানবিকতা আর স্বাধীনতার প্রশ্নে গণমাধ্যম অক্ষুণ্ন রাখবে তার আপসহীন সংগ্রাম। আমাদের এ স্বাধীন দেশে স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে প্রথম সোচ্চার হয়েছিল গণমাধ্যমই। তাই গণমাধ্যম-কর্মীরা বলতেই পারে তাদের দায়বদ্ধতা কখনোই সরকারের কাছে নয়। অবশ্যই জনগণের কাছে। তৃতীয় বিশ্বে গণমাধ্যম শক্তিশালী নয়, তাই গণতন্ত্রের শেকড় এসব দেশে কখনোই গভীরে প্রোথিত হতে পারেনি। মার্কিন সাংবাদিক ওয়াল্টার লিপম্যান তার লিবার্টি অ্যান্ড দি নিউজ গ্রন্থে বলেন, গণমাধ্যম তার নির্ধারিত পথে চলতে না পারার কারণে পশ্চিমা ও উন্নত বিশ্বের গণতন্ত্রও আজ হুমকির মুখে। সেই সঙ্গে জনকল্যাণের বিষয়টিও আজ পিছিয়ে পড়ছে। গণমাধ্যমের প্রধান চালিকাশক্তি হচ্ছে বস্তুনিষ্ঠতা। ইনসুন্জ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ক্লডিয়া শেয়ার্জের মতে, এখন এ বস্তুটি (বস্তুনিষ্ঠতা) একেবারে অসম্ভব হয়ে পড়েছে। গণমাধ্যমের প্রধান লক্ষ্য সত্য, সততা, অখণ্ডতা, পক্ষপাতহীনতা, বস্তুনিষ্ঠতা, স্বাধীনতা ও মূল্যবোধের ভিত আজ ক্রমেই ক্ষীণ হয়ে আসছে। ফলে গণমাধ্যমকর্মীরা শিকার হচ্ছেন চরম দুর্ভোগের। মিডিয়ার স্বাধীনতা যত বেশি তার দায়িত্বও তত বেশি—এ কথাটি মাথায় রেখে গণমাধ্যমকর্মীদের পূর্ণ পেশাদারিত্বে ফিরে আসতে হবে। নচেত্ গণমাধ্যমের দুর্ভোগের জন্য তার নিজের দায়টাও কোনো অংশে কম হবে না। গণতন্ত্র ও গণমাধ্যমকে আমরা বলতে পারি রেললাইনের দুটি পাত। তার কোনো একটি পাতে সামান্য ত্রুটি দেখা দিলেই দুর্ঘটনা অনিবার্য। তাই কোনো গণতান্ত্রিক শাসক কোনো দিন গণমাধ্যমকে তাদের প্রতিপক্ষ ভাবতে পারে না। গণমাধ্যমকে যদি তারা তাদের প্রতিপক্ষ ভাবে তাহলে বুঝতে হবে, ওই সরকারের পায়ের তলার মাটি সরে গেছে।